আলেয়া


 আলেয়া

মৃগাঙ্ক রায়


মুর্শিদাবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বাংলার গ্রামীণ বিস্তৃতির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি অজানা গ্রাম, হরিহরপুর। তবে বিগত কয়েক সপ্তাহ নাগাদ গ্রামের জনসংখ্যা ক্রমশ কমেই চলেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে গ্রামের পথঘাট ক্রমশ শুনশান হয়ে যায়। সন্ধ্যে সাতটার পর গ্রামটি এমন এক জায়গায় পরিণত হয় যেখানে মনে হয় সময় স্থির হয়ে রয়েছে।যদিও গ্রামটি এখন যে চেহারা ধারণ করেছে সেটা কোনকালেই এমনটা ছিল না। তবে একে একে গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আজ এই দশা। 

যে কজন গ্রামবাসী এখনো বাকি রয়েছে, তারা দিনের আলোর ম্লান হওয়ার সাথে সাথেই  নিজেদের গ্রামের উপকণ্ঠে এক বনের সামনে এসে উপস্থিত হয় পূজো দেওয়ার জন্য। যদিও তারা কিসের পুজো দেয়, নিজেরাও এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।কারণ মাঝরাত হওয়ার সাথে সাথেই বনের মধ্যে চলতে থাকে এক আলোর নৃত্য যা কমবেশি গ্রামের সকলেই নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।

খুব অল্প দিনেই ইন্টারনেট মাধ্যমে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ার দরুন পাশের শহরের বিজ্ঞান মঞ্চের কানেও এই বিভ্রান্তিকর দৃশ্যের কথাটি পৌঁছায়। কৌতুহলী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিজ্ঞান মঞ্চ যা কলেজের কিছু ছাত্রদেরকে নিয়ে গড়ে উঠেছে তারা শীঘ্রই তাদের সংগঠনের দুই উজ্জ্বল সদস্য পাপন আর অর্ককে হরিহরপুর গ্রামে পাঠায়।

গ্রামে গিয়ে তারা সেসব গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ঘটনাটির বিশদ জানতে চায়, যারা ঘটনাটিকে প্রত্যক্ষ করেছিল । তাদের সবার কথা মত মাঝ রাতে বনের দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই আলোর দেখা মেলে। সারারাত আলোর খেলা চলে তারপরে ভোর হওয়ার আগেই আলো গুলো কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তবে গ্রামবাসীদের কথা শুনে অর্ক এবং পাপন যা বুঝল সেটা হল যে গ্রামবাসীরা কখনো সেই আলো গুলোকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সাহস করেনি। তাই জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার পর, তারা দুজন মিলে দুপুরের আলোয় বনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অনুসন্ধান চালায়।

অনুসন্ধান চালাতে গিয়েই সেই অঞ্চলে তাদের একটি বিস্তৃত জলাভূমি চোখে পড়ে। জলাভূমি দেখার সাথে সাথে তারা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অনুমান করতে পারে।বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে আলেয়া কিম্বা উইলো দ্যা উইস্প। সচরাচর জলাভূমির পচা কচুরিপানা এবং আগাছা থেকেই মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। আর সেই মিথেন গ্যাসের কারণে ই এই আলেয়ার সৃষ্টি। 

তবে গ্রামে গিয়ে এই কারণ বলার পরেও গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করা গেলনা। অতএব তাদের কাছে একটাই রাস্তা পড়ে রইল, রাতে থেকে ঘটনাটির ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং ঘটনাটিকে ক্যামেরাবন্দি করে গ্রামবাসীদের কে এর পেছনের বৈজ্ঞানিক সত্য আরো ভালো ভাবে  ভিডিও মারফতে বুঝিয়ে দেওয়া।

আর যেমন ভাবনা তেমনই কাজ, তাই রাত্রি স্থির হওয়ার সাথে সাথে তারা ঘটনাটিকে ক্যামেরাবন্দী করার জন্য বনের ভেতরে ঢুকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের জলাভূমির সামনে বসে রইল । জলাভূমির দিকে তাক করে ক্যামেরার ট্রাইপড সেট করা হলো, যদিও তাদের সাথে ই.এম.এফ মিটার ছিল তবুও তারা জানত যে সেটা দরকার পড়বে না।

রাত একটা বাজার সাথে সাথেই তারা লক্ষ্য করল সেই আলেয়া গুলোকে। তবে তাদের ট্রাইপডে রাখা ক্যামেরায় কোন ছবিই ধরা পড়ল না, কারণ তারা দিক ভুল করেছে। তারা ভেবেছিল আলেয়া গুলো সেই জলাভূমিতে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাসের উপর থেকেই আসবে কিন্তু তাদের কে চমকে দিয়ে আলেয়া গুলো জলাভূমির উপর তো নয়ই বরং বড় বড় গাছের উপরে অনবরত ছোটাছুটি করছে। হঠাৎই বাতাস এক অদ্ভুত শক্তিতে ভরে গেল এবং আলো গুলো আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে তাদের চারপাশে একটি ইথারের আভা তৈরি করল। আলোর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথেই তারা বুঝতে পারল যে এক অপ্রত্যাশিত উপসংহার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আলো গুলো ক্রমশ নিচে নেমে এলো। তারা প্রথমে যাকে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা বলে মনে করেছিল তা একটা এমন বস্তুর আকার ধারণ করল যাকে পৃথিবীর ভাষায় বলে, ইউ.এফ.ও । হ্যাঁ, তারা স্পষ্টতই দেখতে পেল যে এক নিরেট গোলাকার রূপালী বর্ণের উজ্জ্বল বস্তু মাটির থেকে প্রায় ৬ মিটার ঠিক তাদের মাথার উপরেই ভাসছে। দীপ্তির এই চমকপ্রদ আলো এক অন্ধ বনকে এতটাই দীপ্তিতে রূপান্তরিত করলো যে পাপন আর অর্কের মনে হল যে তারা নিজেদের একটি পরিচিত জায়গা ছেড়ে এক ভিন্ন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাদের শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ বিভ্রান্তিতে কাঁপছিল। তাদের মাথা এতটাই ভারী হয়ে এসেছিল আর চেতনা এমন এক রাজ্যে পৌছে গেছিল যেখানে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে মস্ত বড় এক ফাটল দেখা দেয়।  ক্রমশ তারা দুজনে অচৈতন্য হয়ে পড়লো।

ঘটনার তিনদিন হল , তবুও অর্ক আর পাপন এখনও গ্রামে ফিরে আসেনি। উদ্বেগ আর হতাশা কাটিয়ে তাদের পরিবার তাদের নিখোঁজ হওয়ার এফ আই আর পুলিশ স্টেশনের দায়ের করলো। ক্রমশ দিনগুলো পরিণত হলো মাসে আর মাস গুলো পরিণত হল বছরে, তবুও কোন খবর পাওয়া গেল না।

তবে ঘটনাটির শেষ এখানেই নয়, সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা যেটা, সেটা হল, নিরুদ্দেশ হওয়ার মোটামুটি চার বছর পর বিহার আর নেপাল  সীমান্ত অঞ্চলে একসাথে ১০ জন ছেলের অপহরণ ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে পাওয়া গেল অর্ক আর পাপনকেই। থানায় নিয়ে আসার পর পুলিশ জানতে পারে তাদের নামে মিসিং রিপোর্ট রয়েছে। বাড়িতে খবর দাওয়াতে বাড়ির লোকেরা তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ঠিকই কিন্তু তাদের সাথে খুব একটা বেশি কথা হয়নি। অর্ক আর পাপন একসময় যারা বিজ্ঞানমনস্ক, প্রাণবন্ত ২৩ বছরের যুবক ছিলো,  তারা এখন অপরিচিতের মুখোশ পড়ে  নিস্তব্ধ সুরে নিজেদের মধ্যেই এক অজানা ভাষায় কথা বলে চলছিল। পুলিশের অনেক জেরার পরেও কোন কিছু উদ্ধার করা গেল না কারণ তাদের কথা বলার ভাষা কিছুতেই কারো বোধগম্য হচ্ছিল না। যদিও কোর্টে ট্রায়ালের তিনদিন আগেই তারা হঠাৎ ই জেল থেকে উধাও হয়ে যায়।

**হ্যাঁ, আর একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার রয়েছে যেটা হলো, এই ঘটনাটি অনেকদিন আগে আমি এলিয়েন সাবরেডিটে পোস্ট করেছিলাম,  আর একজন ইওফলজিস্ট সেটা নিয়ে তার একটি থিওরি উপস্থাপন করেছিলেন । সেই থিওরি মতে, বিহারে পাওয়া অর্ক এবং পাপন আদতেও আসল অর্ক ও পাপন ছিলনা। ছিলো তাদের এলিয়েন ক্লোন, এক আলেয়া।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form