ভুতোর কালীপুজো

ভুতোর কালীপুজো
- মৃগাঙ্ক রায়


"৪১ ৪২ ৪৩ ৪৪ ৪৫.... আর বাকিগুলো সব খারাপ হয়ে গেছে? " জিজ্ঞেস করে ভুতো।
"হ্যাঁ ভুতো বাবা, লাইটিং গুলো বাইরে রাখা ছিল তো তাই আর বাকিগুলো জ্বলছে না"। রামলাল উত্তর দেয়।
অরণ্যপুরের জমিদার বংশের বর্তমান কনিষ্ঠ সন্তানের নাম ভূপেন্দ্র চন্দ্র রায়, ওরফে ভুতো। যদিও সে কলকাতার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস নাইনের ছাত্র, তবে পুজোর ছুটিতে হোস্টেল থেকে প্রত্যেকবারের মতো এবারও তার বাড়ি আসা। পড়াশোনা খেলাধুলা সবেতেই ভালো সে, পরের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা থাকার দরুন হয়তো তার পরের বছর আসা হবে না এই ভেবে এই কালি পূজায় বেশি করে মজা করে নিতে চায় সে।
তবে দুইদিন হল তার বাবা মা দুজনই গিয়েছে মামার বাড়ি ঘুরতে। নিতান্তই বাড়িতে এখন সে একা। সঙ্গে রয়েছে দাদুভাই আর তাদের পুরনো চাকর রামলাল। পুজোর সময় ভুতোর নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যখানে ঘুরতে যাওয়া অত্যন্তই নাপসন্দ। যদিও বাবা মা কালীপূজার দিনই চলে আসবে বলে গিয়েছে।অরণ্যপুরের সবচেয়ে বড় তেতলা বাড়িটা ভুতোদের। ভুতোর এখনও মনে পড়ে, আগেরবারের কালীপুজোর সেই দিনের কথা। যখন ভুতোর বাবা ১০০ খানা টুনি বাল্ব এর চেন এনে লাগিয়েছিল। লাইটিং গুলো যখন সবকটা একসাথে জ্বলেছিল, পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা, তাদের দালান বাড়িটকেই লাগছিল! পাশের অনাথ বাবুরাও যদিও আগের বার পুজোর সময় লাইটিং লাগিয়েছিল তবে তাদের থেকে ঢের গুন বেশি লাইট ছিলো ভূতোদের দালান বাড়িতে। তাদের বাড়ির লাইট দেখার জন্য পাড়ার বাচ্চারা যখন সবাই একে একে এসে জুটেছিল খুব গর্ববোধ হচ্ছিল ভুতোর। কারণ ভুতো জানত একসাথে এতগুলো লাইটিং পাড়ার আর কারোই বাড়িতে নেই, তাই তাদের বাড়িটাই সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল।
তবে এবার কালীপুজোর দুদিন আগে ভুতো যখন রামলাল কে লাইটিং গুলো বের করতে বলে, রাম লাল বলে বেশিরভাগ লাইটিংই নাকি খারাপ হয়ে গেছে। ভুতো চেয়েছিল বাবা মা বাড়িতে ফিরে আসার আগেই লাইটিং দিয়ে বাড়িকে সাজিয়ে বাবা মাকে তাক লাগিয়ে দেবে। , কিন্তু ১০০ খানা লাইটিং এর মধ্যে ৫৫ টাই নাকি অকেজো। বেচে রয়েছে মাত্র ৪৫ খানা।তাহলে আগেরবারের মত কি সে তাদের বাড়িকে সাজাতে পারবেনা?
দুর্গাপুজোর সময় অনাথ বাবুর ছোট ছেলেটা আবার ভুতোকে বলেছে তার বাবা নাকি কলকাতা থেকে এবার বিশেষ ধরনের লাইটিং এনেছে, সেগুলোয় আবার সাউন্ড এর সাথে সাথে রং ও চেঞ্জ হয়। খুব পাকা ছেলেটা, এইটুকু বয়স হলেও কি চটাং চটাং কথা বলে। একদম সহ্য হয়না ভুতোর। মনে মনে ভাবে সে, নাহ! কিছু একটা করতেই হবে। এদিকে বাবা কে বলে যে পাশের শহর থেকে লাইটিং আনাবে সেই সুযোগ টুকুও নেই এবার তার। অন্যদিকে রামলাল ও একটা মস্ত বোকা, আগের বার পাশের গ্রামের চড়ক মেলায় গিয়েই হারিয়ে ফেলেছিল বাড়ি আসার পথ, তাই তাকে দিয়েও হবেনা।
মনে মনে ভাবে তাকেই যেতে হবে এবার! দাদুভাই কে নিয়ে গেলে কেমন হয়? এইতো একটা ভালো বুদ্ধি পেয়েছে এবারে সে।
সম্ভ্রান্ত জমিদার বাড়ির একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন ছোট থেকেই কোনো কিছু চাইতে হয়নি ভুতো কে। সে চাওয়ার সূযোগ টুকুও পায়নি কোনোদিনও। কারণ তার চাওয়ায় আগেই সব এসে হাজির হতো ভুতোর সামনে। তাই এবারও ব্যতিক্রম হলনা। দাদুভাই কে একবার বলতেই দাদুভাই ভুতোকে নিয়ে শহরে যেতে রাজি হয়ে গেলেন । তাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের শহরের দূরত্ব ৩০ কিলোমটারের কাছাকাছি। দোকানে গিয়ে দাদু যখন ভুতোকে জিজ্ঞেস করে কটা চেইন লাগবে, ভুতো বলে ১০০ টা। দাদুর একমাত্র আদরের নাতি হওয়ায় দাদুও তার আবদার পূরণ করে।
"আগের বারের ৪৫ আর এখন ১০০ মোট ১৪৫ টা"। ৫০০০ টাকার লাইটিং কিনে বাড়ি ফিরে আসার পথেই মহা আনন্দে মোট লাইটিং চেইনের সংখ্যা হিসাব করে নেয় ভুতো। এবার তাদের বাড়ির লাইটিং আগের বারের থেকেও অনেক বেশী সুন্দর হবে। অনাথ বাবু যতই নতুন ধরনের লাইটিং লাগাক না কেন, তাদের বাড়ির ১৪৫ খানা লাইটিং চেইনের সামনে সব আলোই ফিকে পরে যাবে, মনে মনে ভেবে উৎফুল্ল হয় সে।
বিকেলবেলা বাড়িতে এসেই, রামলালের ডাক পড়ে। ভুতো বাবার হুকুম, তাই এবার লাইটিং লাগানোর পালা। প্রত্যেকটা চেইন পরপর ছাদ থেকে নিচ অবদি ঝুলবে। প্রথমে হলুদ তারপরে লাল তারপরে নীল তারপরে সবুজ এইভাবে। কথা অনুসারে কাজ শুরু হলো, রামলাল প্রত্যেকটা লাইটিং ছাদ থেকে একে একে করে পরপর নিচ অব্দি, ঝুলিয়ে দিতে শুরু করল। ভূতো আবার সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছে নিচে দাড়িয়ে যাতে প্রত্যেকটার মধ্যে সমান গ্যাপ হয়। এবার পাড়ার সকলের এতগুলো লাইট একসাথে দেখে তাক লেগে যাবে এই ভেবেই ভুতোর মন আনন্দে আত্মহারা।
বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা আসার পালা, এক একটা করে চেইন নিচ অব্দি ঝুলছে আর লাইনের প্রতিটা লাইট জ্বলে উঠছে। কি সুন্দরটাইনা লাগছে। এমন সময় দূর থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে আর তার বাবার কথোপকথন শুনতে পায় ভুতো। শ্যাম কাকা ও তার ৬ বছরের ছোট্ট মেয়ে মিষ্টি। দুজনকেই চেনে ভুতো। কারণ বাড়ির সামনের উঠানে খুব আগাছা ঘাস জন্মালে শ্যাম কাকাকেই ঘাস পরিষ্কার করতে ডাকা হয়। আর এছাড়াও গাছে উঠে নারকেল পাড়তে শ্যামকাকার জুরি মেলা ভার। ছোটবেলাতে শ্যমকাকাই তো ভুতো কে লাট্টু চালানো শিখিয়েছিল। এখনও মনে আছে ভুতোর সেই কথা। শ্যাম কাকার বাড়ি যাবার রাস্তা টা ভুতোদের বাড়ির সামনে হয়ে যায়। শ্যাম কাকা নিশ্চয় ভুতোকে আজ লক্ষ করেনি, নাহলে ঠিক ডাক দিত তার নাম ধরে।
তবে ভুতো তাদের কথবার্তা ঠিক শুনতে পায়..
-"বাবা ওগুলো কি লাগাচ্ছে গো?"
-"জানিনা বাবা চল তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল তোর জন্য নিমকি এনেছি"
-"বাবা দেখো লাইট জ্বলছে"
-"ধুর ওসব ফালতু জিনিস, ওসবে কিছু হয় নাকি"
-"হ্যাঁ ঠিক বলেছ বাবা"
-"আমরা কাল মাটি দিয়ে সুন্দর সুন্দর প্রদীপ বানিয়ে জ্বলাবো, এর থেকে অনেক ভালো সেটা"
-"হ্যাঁ বাবা লাইটিং এর থেকে প্রদীপ অনেক ভালো। লাইটিং তো বাল্বই জ্বলে তাইনা বাবা?"
এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিষ্টি আবার বলে ওঠে,
-"... বাবা আমাদের টাকা হলে আমরাও এরকম লাইটিং লাগাব হ্যাঁ?"
-"হ্যাঁ মা, তখন আমরা অনেক লাইটিং লাগাব। এর চেয়েও অনেক বেশি"।


কথাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে, তারপর মিলিয়ে যায় সন্ধার অতল কালো ছায়ায়। ভুতোর মনটা হটাৎ করেই কেনো যেনো ভারী হয়ে যায় দূর থেকে এই কথাগুলো শুনে। কিছুক্ষণ থ হয়ে যায়। কথা গুলো যেনো তার মনে মনে rewind আর playback করতে থাকে, হয়তো এই মূহুর্তেই একটা লাইটিং জ্বলে উঠবে!
ছাদের উপর থেকে কানাই লাল জোর গলায় হাক দেয় "ভুতো বাবা! দেখোতো এই লাইট টা সমান হয়েছে কিনা আগেরটার সাথে?"
কোন উত্তর দেয় না ভুতো। কিছু একটা ভাবছে সে।
পরমুহূর্তেই সে হুট করে বলে ওঠে...
"কানাইলাল কতগুলো চেইন লাগানো হয়েছে গো?"
" আশিটার মত হবে প্রায়" কানাইলাল উত্তর দেয়..
"আচ্ছা ছেড়ে দাও আর বাকিগুলো লাগাতে হবে না" ভূতো নিচ থেকে জোর গলায় বলে।

পরের দিন সকালবেলা ভুতো গিয়ে শ্যাম কাকার বাড়িতে কুড়িটা লাইটিং চেইন দিয়ে এসেছিল আর বলেছিল "বাবা পাঠিয়েছে"। মিষ্টি সেটা পেয়ে তো বেজায় খুশি। আর বাকি যে কটা লাইটিং বেঁচে ছিল ভুতো সেগুলোকে তাদের বাড়িতে লাইটিং দেখতে আসা বাচ্চাদের মধ্যে ৩-৪ টে করে ভাগ করে দেয়।

ভূতোর সেটাই ছিল নিজের গ্রামের বাড়িতে কাটানো শেষ কালীপূজা, কারণ তার পরের বছর মাধ্যমিক তারপর উচ্চমাধ্যমিক সবশেষে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বম্বে চলে যাওয়ার দরুন ভুতোর আর কালীপুজোর সময় নিজের গ্রামের বাড়িতে থাকা হয়ে ওঠেনি।

তবে হ্যাঁ, যে যাই বলুক না কেন সেবার কালীপুজোয় সত্যিই সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল আলোটা ভুতোদের বাড়িতেই জ্বলে উঠেছিল।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form